অনার্স ২য় বর্ষ | বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-১ | প্রশ্ন ও উত্তর পর্ব-১

অনার্স ২য় বর্ষ | বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-১ | প্রশ্ন ও উত্তর পর্ব-১


অনার্স বাংলা বিভাগের ধারাবাহিক পর্বে  আজকের বিষয় অনার্স ২য় বর্ষের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-১

প্রশ্ন তালিকা:

১।  অন্ধকার যুগে রচিত বিভিন্ন সাহিত্যের পরিচয় দাও।

২।  বারমাস্যা'  বলতে কী বুঝ? 

৩।  রূপকথা ও উপকথা বলতে কি বোঝ?

৪।  ডাক ও খনার বচন বলতে কি বোঝায়?

৫।  মঙ্গলকাব্যের জনপ্রিয়তার কারণ কী?


 অন্ধকার যুগে রচিত বিভিন্ন সাহিত্যের পরিচয় দাও।

উত্তর : বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের শুরুতেই ১২০০ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত সময়কে তথাকথিত ‘অন্ধকার যুগ' বলে একটি বিতর্কিত বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। এই দেড়'শ বছরে বাংলায় কোনো উৎকৃষ্ট সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি হয়নি।

অন্ধকার যুগের সাহিত্যকর্ম : অন্ধকার যুগে উৎকৃষ্ট সাহিত্য সৃষ্টি না হলেও এ সময় বাংলা সাহিত্যের কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়, 'সেক শুভোদয়ার' অন্তর্গত পীর মাহাত্মা জ্ঞাপক 'বাংলা আর্য', অথবা ভাটিয়ালী রাগেন গীরতে নির্দেশক বাংলা গান, রামাই পণ্ডিতের 'শূন্যপুরাণ' নিরঞ্জনের রুম্মা শীর্ষক গীতিকবিতা এবং ডাক ও খনার বচন প্রভৃতি এ সময়ে রচিত অন্যতম সাহিত্যিক নিদর্শন ।

সেক শুভোদয়া : 'সেক শুভোদয়া রাজা লক্ষণ সেনের সভাকবি হলায়ুধ মিশ্রের রচিত। এটি সংস্কৃত গদ্যপদ্যে লেখা এক ধরনের চম্পুকাব্য, আনুমানিক খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে এই গ্রন্থটি রচিত। এ গ্রন্থে নানা ঘটনার মাধ্যমে মূলত পীরদের মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে।

শূন্যপুরাণ : রামাই পণ্ডিত রচিত 'শূন্যপুরাণ' ধর্মপূজার শাস্ত্রগ্রন্থ। বৌদ্ধদের শূন্যবাদ এবং হিন্দুদের লৌকিক ধর্মের সম্মিলনে ধর্মপূজার প্রতিষ্ঠা, শূন্যপুরাণে প্রাচীন বাংলা ভাষার প্রভাব রয়েছে। এ কাব্যের অন্তর্গত 'নিরঞ্জনের রুষ্মা' নামক কবিতাটি তুর্কি বিজয়ের পরে অর্থাৎ ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকের রচনা বলে মনে করা হয়।

ডাক ও খনার বচন : 'ডাক ও খনার বচন' লোকসাহিত্যের অন্যতম নিদর্শন। তবে এসবের কোনো লিখিত নিদর্শন নেই, সৃষ্টির পর থেকে তা মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে আসছিল । তাই এগুলোর ভাষা ও অরয়ব অনেক পরিবর্তিত হয়েছে।

সুতরাং, সার্বিক আলোচনার পরিশেষে বলা যায়, উক্ত সাহিত্যিক নিদর্শনসমূহ বাংলা সাহিত্যকে অন্ধকার যুগের অপবাদ থেকে মুক্তি দিয়েছে।


✅ বারমাস্যা'  বলতে কী বুঝ? 

উত্তর : বারমাস্যা : বাংলা মধ্যযুগের সাহিত্যে 'বারমাসী' গীতগুলো এক অপূর্ব সৃষ্টি। মঙ্গলকাব্য ও মৈমনসিংহ গীতিকাগুলোতে এ বারসামী বর্ণনার উল্লেখ রয়েছে। বারমাসী মূলত বিরহ কাতর নায়িকার বিরহ-পীড়িত মনের এক নিখুঁত চিত্র। যেকোনো ধরনের একটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে উপলক্ষ্য হিসেবে নায়িকা নায়ককে দোষারোপ করে (বা না করে) দীর্ঘ বারো মাসের নায়ক নায়িকার অর্থনৈতিক দৈন্য বা মানসিক বিরহের যে বর্ণনা প্রদান করে তাকেই বারমাস্যা বলে। তবে শুধু নারীর বিরহ-বেদনাই নয় মানবমনে আলোড়ন সৃষ্টিকারী যেকোনো করুণ কাহিনিই ছিল বারমাসীর উপজীব্য বিষয়। বারমাসীর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এ বর্ণনা সকল ক্ষেত্রে অগ্রহায়ণ বা বৈশাখ মাস হতে আরম্ভ হয় না, যে কাহিনির যে মাসে সূত্রপাত সে মাস হতেই কবি বর্ণনা শুরু করেন। কালকেতু উপাখ্যান হতে ফুলুরার বারমাস্যার দৃষ্টান্ত নিম্নে তুলে ধরা হলো-

জ্যৈষ্ঠ    -   পাপিষ্ঠ জ্যৈষ্ঠ মাসে প্রচণ্ড তপন ।

             খরতর পোড়ে অঙ্গ রবির কিরণ।

আষাঢ়    -    আষাঢ়ে পূরিল মহী নব মেঘে জল ।

                   ছাগল চরাতে প্রভু নাহি পাই স্থল, 

শ্রাবণ     -    শ্রাবণে বরিসে মেঘ দিবস রজনী

                     সিতাসিত দুই পক্ষ একাই ন জানি,

ভাদ্র   -   ভাদ্রপদ মাসে বড় দুরন্ত বাদল।

                 নদনদী একাকার আটদিকে জল ।

আশ্বিন   -  উত্তম  বসনে কেশ করযে বনিতা।

                   অভাগী ফুল্লরা করে যে উদরের চিন্তা

 কার্তিক   -   কার্তিক মাসেতে হৈল হিমের প্রকাশ, 

                    কর যে সকল লোক শীত নিবারণ ॥

   এভাবে অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র প্রতিটি মাসেই ফুল্লুরার কষ্টকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। মুলত কবি এ বারমাসী বর্ণনার মধধ্যদিয়ে সমসাময়িক কালের সাধারণ মানুষের জীবন চিত্র ফুটিযে তুলেছেন।


✅ রূপকথা ও উপকথা বলতে কি বোঝ?

উত্তর : রূপকথা ও উপকথা: লোককথা বা লোককাহিনী লোকসাহিত্যের অন্যতম শাখা। গদ্যের মাধ্যমে কাহিনি বর্ণিত হলে তাকে লোককথা বলা হয়। মানুষের গল্প শোনার চিরন্তন প্রবৃত্তি থেকেই এর উৎপত্তি হয়েছে। বিষয়ভেদে লোককথা কয়েক ভাগে বিভক্ত। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- রূপকথা ও উপকথা। নিম্নে এদের সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

রূপকথার কাহিনি সাধারণত দীর্ঘতর হয়। কোনো অপুত্রক রাজার দৈববলে পুত্রলাভ, ভাগ্যান্বেষণে রাজপুত্রের দেশান্তরে অভিযান এবং বহু বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে সাফল্য লাভ, পরিণামে কোনো রাজকন্যা ও অর্ধেক রাজলাভ করে সুখে কালযাপন- এই ধরনের কাহিনিগত কাঠামোর ওপর রূপকথার ভিত্তি ও বিকাশ। অলৌকিক, রহস্যময় জগতের বিচিত্র কাহিনি রূপকথার উপজীব্য। রূপকথা বিশেষ কোনো দেশ বা কালের সমাজ, ধর্ম, নীতি সৌন্দর্যবোধ আশ্রয় করে না। এর আবেদন বিশ্বজনীন। দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদারের 'ঠাকুরমার ঝুলি জনপ্রিয় রূপকথা গ্রন্থ ।

উপকথা পশুপক্ষীর চরিত্র অবলম্বনে নানা কাহিনি নিয়ে গড়ে ওঠে। কৌতুকসৃষ্টি ও নীতিপ্রচার এ রচনার মূল উদ্দেশ্য। উপকথায় মানবচরিত্রের মতোই পশুপাখির বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে বক্তব্য পরিবেশিত হয়। মানুষের মতোই পশু পাখিরা কথা বলে নিজ নিজ ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে পশুপাখি রূপকার্থে ব্যবহৃত হয় ।

সুতরাং সার্বিক আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে রূপকথা ও উপকথার নানা গল্প প্রচলিত আছে। যা সুপ্রাচীন কাল থেকে মানুষের আনন্দের উৎস হয়ে আছে।


✅ ডাক ও খনার বচন বলতে কি বোঝায়?

উত্তর : ডাক ও খনার বচন : ডাক ও খনার বচন বাংলা লোকসাহিত্যের উপাদান। এগুলো গঠনের দিক থেকে মূলত ছড়ার মতো। ডাক ও খনার বচন যে রূপে সৃষ্টি হয়েছিল তার কোনো লিখিত নিদর্শন নেই । মুখে মুখে প্রচলিত থাকার ফলে তার ভাষা হয়ে পড়েছে আধুনিক যুগের উপযোগী।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রাচীন যুগের অন্যতম নিদর্শন ‘ডাকার্ণব' । এই গ্রন্থের আদর্শে রচিত হয়েছে ডাকের বচন। তবে জনক কে ছিলেন এ নিয়ে রয়েছে নানা মতভেদ। আচার্য হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, “ডাক এবং ডাকিনী বলতে তন্ত্রশাস্ত্রে অভিজ্ঞ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হচ্ছেন এক শ্রেণির বৌদ্ধ তান্ত্রিক সাধক। ডাকের রচনাকাল সপ্তম শতাব্দী থেকে নবম শতাব্দী ধরা হয়।” এবং সন্ন্যাসিনীকে বুঝায়।” ড. দীনেশচন্দ্র সেনের মতে, ‘ডাক বলতে প্রচলিত বাক্যকে বুঝায়।” 

অন্যদিকে খনা বলতে একজন ব্যক্তিবিশেষকে বুঝানো হয়। খনা বরাহমিহিরের স্ত্রী, তিনি বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার সাথে যুক্ত ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। খনা ছিলেন একজন বিদুষী মহিলা। খনাকে বাঙালি কবি বলে মনে করা হয় এবং তার সময়কাল ৮০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বলে মনে করা হয়। খনা কর্তৃক কথিত মূল্যবান বচনসমূহই খনার বচন নামে পরিচিত।

ডাক ও খনার বচনে লোকজীবনের দৈনন্দিন বিশ্বাস, আচরণ ও বণ্ডিত জীবনগাঁথা স্থান পেয়েছে। বিশেষত কৃষিকাজের ও দৈনন্দিন জীবনের অতি প্রয়োজনীয় সূত্রগুলো এখানে ছন্দাকারে রচিত হয়েছে। তাই সমাজজীবনে ডাক ও খনার বচনের প্রায়োগিক মূল্য অপরিসীম। এমন কয়েকটি ডাক ও খনার বচন নিয়ে তুলে ধরা হলো- 

১. কলা করে না কাট পাত।

তাতেই কাপড় তাতেই ভাত।

২. কার্তিকের ঊনা জলে ।

খনা বলে দুনো ফলে।

৩. জ্যৈষ্ঠে ওকো আষাঢ়ে ধারা,

শস্যের ভার না সহে ধরা।


✅ মঙ্গলকাব্যের জনপ্রিয়তার কারণ কী?

উত্তর : ভূমিকা : বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে ধর্মবিষয়ক বিশেষ একশ্রেণির আখ্যানমূলক রচনাকে মঙ্গলকাব্য বলে। মানুষের বিশ্বাস মতে, দেবদেবীর মাহাত্ম্য নির্ভর যে কাব্য রচনা পাঠ ও শ্রবণ করলে নিজের প্রতিবেশীর ও সমাজের মঙ্গল বা কল্যাণ সাধন হয় তাকে মঙ্গলকাব্য বলা হয়। খ্রিস্টীয় পনেরশ শতক থেকে আঠারো শতকের শেষার্ধ পর্যন্ত লৌকিক ও পৌরাণিক সংমিশ্রিত দেবদেবীর লীলামাহাত্ম্য এতে প্রচারিত হয়। মঙ্গলকাব্য প্রধানত চার প্রকার । যথা : চন্ডীমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, মনসা মঙ্গল, কালিকা মঙ্গল ও শীতলা মঙ্গল ইত্যাদি ।

এ মঙ্গলকাব্য জনপ্রিয়তার কারণ : নিম্নে মঙ্গলকাব্য জনপ্রিয়তার কারণগুলো আলোচনা করা হলো-

১. মঙ্গলকাব্যগুলো দেব-দেবীর কাহিনি অবলম্বনে রচিত হলেও এতে বাঙালি সমাজ জীবনের ইতিহাস প্রতিফলিত

ধর্ম মঙ্গল,

২. এগুলো কাহিনিগত দিক থেকে কোনো বৈচিত্র্যতা না থাকলেও শিল্পগত বৈশিষ্ট্যের জন্য বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্ট স্থান জুড়ে

আছে মঙ্গলকাব্য।

৩. মধ্যযুগে বাংলাদেশে একবিশাল স্থান জুড়ে বিনোদনের অংশ হিসেবে ছিল মঙ্গলকাব্য।

৪. মঙ্গলকাব্যগুলো অনার্য সমাজ থেকে উদ্ভূত বলে এগুলো একান্ত জীবনমুখী। ফলে আধ্যাত্মিকতার চেয়ে ভোগবাদী প্রধান ছিল।

৫. তৎকালীন বাঙালি সমাজ মঙ্গলকাব্যের উপর নির্ভরশীল ছিল। যেমন- সাপের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অনার্য সমাজ মনসার পূজা দিত।

৬. মধ্যযুগের বাঙালি সমাজ পার্থিব জীবনের মঙ্গল কামনার্থে মনসা, ধর্মঠাকুর, চন্ডীদেবীর পূজা, অনুদা, শীতলা, লক্ষ্মী ও সত্যনারায়ণের পূজা দিয়ে যাবতীয় অমঙ্গল থেকে নিজেদের রক্ষা করতো।

৭. মঙ্গলকাব্যগুলোতে সমকালীন ধর্ম ও সমাজ চিত্র অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটে ওঠেছে।


উপসংহার : আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, মঙ্গলকাব্যগুলো সুপ্রাচীনকাল থেকে এদেশের মানুষের জীবনে ঘনিষ্ঠ ছিল। মধ্যযুগে বাঙালি মুসলিম শাসকদের কাছে এদেশের অনার্য সমাজ নির্যাতিত ও নিগৃহীত ছিল। তাই তারা সমাজের শাসকদের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পেতে লৌকিক দেব-দেবীর পূজা দিয়ে সমস্ত অশুভশক্তি ও দেবদেবীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করত। তাই মঙ্গলকাব্যগুলো বাঙালি নিচু হিন্দু সমাজের কাছে খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে ।


🔰 পরবর্তী: অনার্স ২য় বর্ষ | বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-১ | প্রশ্ন ও উত্তর পর্ব-২


Disclaimer: পোস্টটি তৈরি করতে কিছু সহায়ক বইয়ের সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে। তবে তা শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে। পোস্ট সম্পর্কে কারো কোনো মতামত বা অভিযোগ থাকলে আমাদের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post