অনার্স ২য় বর্ষ | বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-১ | প্রশ্ন ও উত্তর পর্ব-২

অনার্স ২য় বর্ষ | বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-১ | প্রশ্ন ও উত্তর পর্ব-২

অনার্স বাংলা বিভাগের ধারাবাহিক পর্বে  আজকের বিষয় অনার্স ২য় বর্ষের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-১

প্রশ্ন তালিকা:

১। চৌতিশা কি?

২। 'রসূল বিজয়' কী?

৩।  মঙ্গলকাব্যের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ কর।

৪।  কবিগানের পরিচয় দাও ।

৫।  'মর্সিয়া সাহিত্য' বলতে কি বোঝ?


✅ চৌতিশা কি?

উত্তর : চৌতিশা : মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে চৌত্রিশটি বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণের এক একটিকে প্রত্যেক চরণের প্রথম অক্ষর হিসেবে ব্যবহার করে যে বিশেষ এক ধরনের কাব্য রীতি প্রচলিত ছিল, তাই চৌতিশা নামে পরিচিত। এই বিশেষ রাতিতে সাধারণত দেবদেবীর স্তুতি, প্রশংসা বা নায়ক কিংবা নায়িকার সারাবছরের দুঃখ, দারিদ্র ও বিরহের কথা বর্ণনা করা হত। মধ্যযুগীয় কাব্যে নায়ক ও নায়িকার অর্থনৈতিক ও প্রেম-বিরহ বেদনা একেক মাসে একে রূপে প্রকটিত, এ বিরহ বেদনার বর্ণনা কোনো কাব্যে বারসারীতে, আবার কোনো কোনো কাব্যে চৌতিশায় বর্ণিত হত। বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য 'চৌতিশা' কবিতাগুলো হলো জয়নবের চৌতিশা, সখিনার চৌতিশা, সৈয়দ সুলতানের জ্ঞানচৌতিশা, এছাড়া, মুকুন্দরামের 'কবিকঙ্কণ চণ্ডী' এবং দৌলত বাহরাম খানের ‘লাইলী-মজনু' কাব্যে চৌতিশার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। ‘লাইলী-মজনু' কাব্যের বর্ণিত চৌতিশার উদাহরণ- 

নিয়ড়ে বালেমু পাই             নির্লক্ষ্য দুখিনী রাই

                 নিরবধি দগধে মদনে ৷

নিদাঘ বিপদ ভার                 নিরঞ্জন বিনে আর

               নিস্তার করিব কোন জনে ॥

নির্ঘাত বিৱহশরে               নিচেতন কৈল্প মোরে

               নিঃশ্বাসেক রহিছে পরাণ ॥

নিশ্চয় অবহুঁ যদি                নিকটে মিলিল নিধি

                নিমেঘ দর্শক পরিত্রাণ।



✅ রসূল বিজয় কী?

উত্তর :ভূমিকা : সৈয়দ সুলতান ছিলেন মধ্যযুগের একজন শ্রেষ্ঠ মুসলিম কবি। তিনি নবি-রসূলগণের জীবন কাহিনি নিয়ে চরিতকথা বা গাঁথাকাব্য রচনা করেন। 'রসূল বিজয়' তাঁর এ ধরনের একটি উল্লেখযোগ্য কাব্য ।

রসূল বিজয় কাব্যের পরিচয় : 'রসূল বিজয়' কাব্যের বিষয় ছিল শবে মেরাজের পর হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ইসলাম প্রচারের কাহিনি বর্ণিত । কাব্যটি আকারে বেশ বড়। এতে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ধর্ম প্রচার ও যুদ্ধবিগ্রহের বর্ণনা করা হয়েছে। বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনের মাহাত্ম্য প্রচারই ছিল এ কাব্যের প্রধান উদ্দেশ্য।

উপসংহার : আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, উপরিউক্ত 'রসূল বিজয়' কাব্যটি প্রসিদ্ধ নবি-রসূলগণের জীবন কাহিনি অনেক চরিতকথা বা গাঁথাকাব্য রচয়িতা সৈয়দ সুলতান রচিত উল্লেখযোগ্য কাব্য ।



✅ মঙ্গলকাব্যের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ কর।

উত্তর : ‘মঙ্গলকাব্য' হচ্ছে দেবদেবী নির্ভর আখ্যানকাব্য। পনের শতক থেকে মঙ্গলকাব্যের উৎপত্তি এবং মধ্যযুগের শেষ কবি ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল' রচনার মাধ্যমে তার পরিসমাপ্তি ঘটে। পৌরাণিক, লৌকিক, আধা-পৌরাণিক বিভিন্ন দেব-দেবীর মাহাত্ম্য প্রচারই মঙ্গলকাব্যগুলোর মূল উপজীব্য। আর্যদের বাঙালি সম্প্রদায় নিজ নিজ সমস্যার সমাধানের উদ্দেশ্য এই “ব-দেবীর স্তুতিমূলক কাব্য পাঠ করত, দেবতাদের কাছে মঙ্গল কামনা করে এ কাব্যগুলো রচিত হয়েছে- তাই মঙ্গলকাব্য।

মঙ্গলকাব্যের বৈশিষ্ট্য :

১. মঙ্গলকাব্য ধর্মভিত্তিক, দেবতাকেন্দ্রিক আখ্যানকাব্য ।

২. দৈবশক্তির বিরুদ্ধে মানবজীবনের দ্বন্দ্বসংঘাত এ কাব্যের মূল বা প্রধান উপজীব্য

৩. প্রত্যেক মঙ্গলকাব্য চারটি অংশে বিভক্ত। (i) বন্দনা, (ii) গ্রন্থ রচনার কারণ বর্ণনা (iii) দেবখণ্ড (iv) নরখণ্ড বা মূলকাহিনী বর্ণনা ৷

৪. সৃষ্টিকথা বর্ণনা প্রসঙ্গে কাব্যলক্ষ্মীরে বন্দনা করা হয় । কবি সাধারণত স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে কাব্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেন।

৫. দেবতা মর্ত্য লোকে পূজা পেতে চেষ্টা করে।

৬. মঙ্গলকাব্যগুলোতে প্রাত্যহিক বাঙালি জীবনের চিত্র ফুটে উঠেছে। সুখ-দুঃখের বারমাসী গান, চৌতিশা, নারীর প্রতি নিন্দার বর্ণনা, বন্ধনশিল্প বর্ণনা, ফলফুল, পশুপাখি আলোচনায় প্রভৃতির অবতারণা করা হয় ।

৭. মঙ্গলকাব্যের ছন্দ প্রধানত পসার ও ত্রিপদী।

৮. মঙ্গলকাব্যে বিভিন্ন পালায় বিভক্ত করে গাওয়া হতো।

৯. মঙ্গলকাব্যে সমকালীন সমাজচিত্র অঙ্কিত হয়।

১০. মঙ্গলকাব্যগুলো হচ্ছে মধ্যযুগের উপন্যাস ।

সুতরাং সার্বিক আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, মঙ্গলকাব্যের বৈশিষ্ট্যগুলো বাংলা সাহিত্যের ধারায় আরো নতুনত্ব এনেছে।



✅ কবিগানের পরিচয় দাও ।

উত্তর : কবিগানের পরিচয় : ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে ভারতচন্দ্রের মৃত্যুর পর থেকে ১৮৬০ সালে আধুনিকতার যথার্থ বিকাশের পূর্ব হতে সময় ছিল বাংলা সাহিত্যের যুগসন্ধিক্ষণ, কবিগণ এই যুগসন্ধিক্ষণের ফসল। সেকালের কলকাতার নব্য ধনী সমাজে এই গীতধারার প্রতিষ্ঠা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিগানের উদ্ভব ইতিহাসকে বর্ণনা করেছেন-

“ইংরেজের নূতন সৃষ্ট রাজধানীতে পুরাতন রাজসভা ছিল না, পুরাতন আদর্শ ছিল না, তখন কবির আশ্রয়দাতা রাজা হইল সর্বসাধারণ নামক এক অপরিণত স্থূলায়তন ব্যক্তি, এবং সেই হঠাৎ রাজার সভার উপযুক্ত গান হইল কবির দলের গান। সন্ধ্যাবেলায় বৈঠকে বসিয়া আমোদের উত্তেজনা চাহিত- তাহারা সাহিত্যরস চাহিত না।”

দুই পক্ষের বিতর্কের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হতো কবিগান। একদল গান গাওয়া শেষ করলে অন্য দল গান গাওয়া শুরু করত। উপস্থিত ক্ষেত্রে গান রচনায় এবং পরিবেশনায় যে দল বেশি কৃতিত্ব দেখাতে পারত, সে দল বিজয়ী ঘোষিত হত। শ্রোতার হৃদয় জয় করাই ছিল কবিগানের কলাবিধির যথার্থ শিল্পকর্ম।

কবিগানে অনুপ্রাস-যমক-অলংকারবহুল ভাষা ব্যবহার করে দর্শককে আকৃষ্ট করা হত। তরজা, ঝুমুর, আখড়াই, হাফ আখরাই প্রভৃতি কবিগানের প্রকারভেদ । কবিগানের চারটি বিভাগ-

(ক) বন্দনা : দেবীবন্দনা এবং উমামেনকা সংক্রান্ত গান গাওয়া হতো।

(খ) সখী সংবাদ : রাধাকৃষ্ণবিষয়ক গান নিয়ে রচিত।

(গ) বিরহ : বিরহ বেদনা সংক্রান্ত গান পরিবেশিত হত।

(ঘ) ঘেউড় : কোনো পৌরাণিক আখ্যান বা চরিত্র সরস, কৌতুক প্রবণ, আদিরসাত্মক ঢঙে প্রশ্নের আকারে পরিবেশিত হত। তবে ঘেউর গানে অশ্লীল, অভব্য ঠাট্টা, বিদ্রূপ চলত, যা ছিল নিম্নমানের।

কবিগান বিশেষ যুগের এক বিশেষ ধরনের সৃষ্টি। যুগের প্রয়োজনেই এই কবিগাণের উদ্ভব হয়েছিল। সাহিত্য বিচারে তা উন্নত ছিল না। তবে কোনো কোনো কবিওয়ালার রচিত গীত মাধুর্যপূর্ণ ছিল এবং ভাষায় কারুকাজও বেশ সূক্ষ্ম ছিল। কবিওয়ালাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন— গোঁজলা গুঁই, ভবানী বেনে, রাসু-নৃসিংহ, হরু ঠাকুর, নিতাই বৈরাগী, রাম বসু, যজ্ঞেশ্বরী, ভোলা ময়রা প্রমুখ, গোঁজলা গুই ছিলেন কবিওয়ালাদের মধ্যে প্রাচীনতম কবি। গোঁজলা গুইয়ের কবিতার পঙক্তি-

তোমাতে আমাতে একই অঙ্গ 

তুমি কমলিনি, আমি সে ভূঙ্গ, 

অনুমান বুঝ আমি ভুজঙ্গ 

তুমি আমায় তায় রতনামণি ॥



✅ মর্সিয়া সাহিত্য বলতে কি বোঝ?

উত্তর : মর্সিয়া সাহিত্য : মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে 'মর্সিয়া সাহিত্য' বিস্তৃত অঙ্গন জুড়ে রয়েছে। 'মর্সিয়া' আরবি শব্দ, এর অর্থ শোক গাথা বা শোক প্রকাশ করা। মর্সিয়া কাব্য বা সাহিত্য মূলত শোককাব্য। কারবালা প্রান্তরে নিহত ইমাম হোসেন ও অন্যান্য শহীদের করুণ কাহিনি নিয়ে এ কাব্য রচিত। হযরত মুহম্মদ (স.) এর দৌহিত্র ও হযরত আলীর পুত্র ইমাম হাসান ও ইমাম হোসেনের অনুসারী হলেন শিয়ারা। চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে দাক্ষিণাত্যের শিয়াদের ও ইরানি শিয়াদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল, সে সূত্রেই ষোল শতকে বাংলায় 'মর্সিয়া সাহিত্য' প্রচলিত হয় ।

মুসলমান মাত্রই মুহম্মদ ভক্ত, তাঁর দৌহিত্র হাসান হোসেনের প্রতি সহানুভূতিশীল। যেহেতু মর্সিয়া কাব্যের নায়ক বিজয়গৌরবহনী, সেহেতু তার প্রধান রস করুণ হতেই হয়। শোকের বা কান্নার আধার বলেই এ বিলাপ প্রধান সাহিত্যের নাম 'মর্সিয়া সাহিত্য বা শোক সাহিত্য'। তবে শোক প্রকাশ‍ই এ সাহিত্যের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। যুদ্ধকাব্য হিসেবেও এগুলো গুরুত্বপূর্ণ । বীরত্বের কাহিনি এসব কাব্যের প্রধান উপজীব্য। সে জন্য মুসলমানদের জাতীয় গৌরব ও ধর্মীয় মর্যাদার প্রকাশক হিসেবে মর্সিয়া কাব্যের বিশেষ অৎপর্য অনুধাবন করা চলে।

মসিয়া সাহিত্যে'র উল্লেখযোগ্য কাজগুলো হলো-

১. দৌলত উজির বাহরাম খানের- ‘ইমাম বিজয়'

২. শেখ ফয়জুল্লাহর 'জয়নবের চৌতিশা'

৩. মুহম্মদ খান- ‘মক্তুল হোসেন কাব্য'

৪. হায়াৎ মামুদ 'জঙ্গনামা'

৫. আব্দুল আলিম- 'হানিফার লড়াই'

৬. নসরুল্লাহ খন্দকার- 'কারবালা কাহিনি'।


🔰 পূর্ববর্তী: অনার্স ২য় বর্ষ | বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-১ | প্রশ্ন ও উত্তর পর্ব-১

🔰 পরবর্তী: অনার্স ২য় বর্ষ | বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-১ | প্রশ্ন ও উত্তর পর্ব-৩


Disclaimer: পোস্টটি তৈরি করতে কিছু সহায়ক বইয়ের সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে। তবে তা শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে। পোস্ট সম্পর্কে কারো কোনো মতামত বা অভিযোগ থাকলে আমাদের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post