প্রশ্ন তালিকা:
১। আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্যচর্চার পরিচয় দাও ।
২। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলমান কবিদের গুরুত্ব আলোচনা কর।
৩। মধ্যযুগের বাংলা লোকসাহিত্যের বিভিন্ন শাখার পরিচয় দাও ।
৪। মধ্যযুগের অনুবাদ সাহিত্য শাখার পরিচয় সংক্ষেপে আলোচনা কর।
৫। মঙ্গলকাব্য কী? চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের বিভিন্ন কবিদের পরিচয় পাও ।
✅ আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্যচর্চার পরিচয় দাও ।
উত্তর : ভূমিকা: মধ্যযুগে আরাকান রাজ্যে বাংলা সাহিত্যের চর্চা এবং আরাকান রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা সাহিত্যের যে বিকাশ সাধিত হয়েছিল তা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আরাকানবাসী কবিগণ ধর্মনির্ভর বাংলা সাহিত্যের পাশে মানবীয় প্রণয়কাহিনি স্থান দিয়ে এক নতুন ধারায় সৃষ্টি করে অভিনবত্ব দেখিয়েছেন। উন্নততর সাহিত্যের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের যোগাযোগ স্থাপন করে এবং কাব্যের বিষয়বস্তুতে বৈচিত্র্য আনয়ন করে আরাকানবাসী কবিগণ ১৬২২ থেকে ১৬৮৪ খ্রি. পর্যন্ত সময়ে বাংলা সাহিত্যের যে অগ্রগতি সাধন করেছিল তা সেসময় বাংলায় আপন গৃহেও সম্ভব হয়নি।
ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর “বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত” গ্রন্থে বলেছেন-
"আরাকানী মুসলমানের বাংলা ভাষাও সাহিত্যকে নিজের প্রাণের ভাষা ও হৃদয়ের ধাত্রী বলে গ্রহণ করেছিলেন।”
আরাকান রাজ্যটি বার্মা (বর্তমান মায়ানমার) অন্তর্ভুক্ত বার্মার উত্তর পশ্চিম সীমায় এবং চট্টগ্রামের দক্ষিণে সমুদ্রের তীরে এর অবস্থান ছিল। আরাকানকে বাংলা সাহিত্যে 'রোসাং' বা রোসাঙ্গ' নামে উল্লেখ করা হয়েছে। আরাকানবাসীরা তাদের দেশকে 'রখঈন' নামে অভিহিত করতো। ড. মুহাম্মদ এনামুল হক 'রখইং' শব্দের ইংরেজি অপভ্রংশ 'আরাকান' বলে উল্লেখ করেছেন। আরাকানের অধিবাসীরা সাধারণভাবে বাংলাদেশে 'মগ' নামে পরিচিত। আরাকান রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।
আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্যচর্চার পরিচয় : বাংলাদেশের বাইরে বার্মার অন্তর্ভুক্ত মগের মুল্লুক আরাকানের বাংলা চর্চার বিকাশ বিশেষ কৌতূহলের ব্যাপার বলে মনে হতে পারে।
খ্রিস্টীয় অষ্টম-নবম শতাব্দীতে আরাকান রাজ মইতেং চন্দয় (৭৮৮-৮১০) এর রাজত্বকালে যে সকল আরবিয় বণিক স্থায়ীভাবে সে দেশে বসবাস শুরু করে তাদের মাধ্যমেই ইসলাম ধর্মের প্রচার হয় এবং আরাকান ও চট্টগ্রাম একই রাজ্যভুক্ত ছিল সেই সুবাধে চট্টগ্রামেও ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটে। চট্টগ্রামে ও আরাকানে তখন ইসলামি সংস্কৃতির কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। ধর্মীয় বন্ধনের মাধ্যমে এই দুই অঞ্চলের জনসাধারণের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ শুরু হলে আরাকান রাজারা লক্ষ করলেন যে আরাকানি মঘসভ্যতা, রাষ্ট্রনীতি ও আচার ব্যবহার হতে বঙ্গের মুসলিম সভ্যতার রাষ্ট্রনীতি ও আচার ব্যবহার অনেকাংশে শ্রেষ্ঠ ও উন্নত। তাই আরাকানি রাজাগণ বঙ্গের মুসলিম প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। এরই সুবাদে আরাকান রাজসভায় বঙ্গীয় মুসলমানদের প্রভাবে বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চার পরিবেশ গড়ে উঠে। বঙ্গের মুসলিম রাজশক্তির সহিত স্বাধীন আরাকান রাজাগণের মোটেই সদ্ভাব ছিল না। অথচ তারা দেশে মুসলিম রীতি ও আচার মেনে চলছিলেন। শুধু তাই নয়, আরাকানে প্রচলিত মুদ্রার এক পিঠে মুসলমানি নাম লেখা হতো। আরাকানে রাজাদের সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন রাজপদে, রাজাদের প্রধানমন্ত্রী, অমাত্য সচিব, কাজী বা বিচারক প্রভৃতি উচ্চপদে মুসলমানরাই দায়িত্ব পালন করেছেন। মুসলমানদের এই প্রভাব ক্রমান্বয়ে ব্যাপক আকারে ধারণ করে সপ্তদশ শতকে তা চরমে ওঠে। আরাকানে মুসলমান প্রভাব সম্পর্কে লস্কর উজির আসকান খানের প্রসঙ্গে দৌলত কাজীর মন্তব্য স্মরণযোগ্য-
“সৈয়দ, কাজী, সেবক, মোল্লা, আলিম, ফকীর।
পূজেন্ত সে সবে যেন আপন শরীর । বৈদেশি, আরবি, চেমী, মোগল, পাঠান।
পালেন্ড সে সবে যেন শরীর সমান।”
আরাকানের মগরাজারা বাংলা ভাষায় কতটুকু ব্যুৎপন্ন ছিলেন তা নিশ্চিত জানা না গেলেও তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায়ই মুসলমান
কবিগণ কাৰ্য্য চৰ্চা কোনো না কোনো সভাসদের পৃষ্ঠপোষকতার ফলেই তা সম্ভব হয়েছিল। আরাকান রাজাদের মধ্যে মেঙৎ-চৌ- মৌন, শ্রীসুধর্মা, চন্দ্র, সুরমা প্রভৃতি রাজার সভায় মুসলমানরা বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে।
আরাকান রাজসভার কবিগণের মধ্যে দৌলত কাজী শরদন, কোরেশী মাগন ঠাকুর, আলাওল, আবদুল করিম, খোন্দকার প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। নিয়ে আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য চর্চার বিভিন্ন সাহিত্যিক নিদর্শনসমূহের নাম দেয়া হলো-
✅ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলমান কবিদের গুরুত্ব আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে যে সমস্ত মুসলমান কবি চিরস্মরণীয় হয়েছেন, যাদের প্রতিভায় বাংলা কাব্যে অভিনব বৈচিত্র্যের সঞ্চার হয়েছিল তাদের প্রায় সকলেই সপ্তদশ শতাব্দীতে চট্টগ্রাম ও আরাকানে বাস করতেন। সৈয়দ সুলতান, মাহমুদ ान, হাজি মুহম্মদ তারা সকলেই সপ্তদশ শতাব্দীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। সৈয়দ সুলতান আটখানা কাব্য লিখেছিলেন। তাছাড়া এ সময় দুইজন কবি কবিতা লিখেছিলেন তাদের কাব্য শুধু মুসলমান সমাজে নয় হিন্দু সমাজেও প্রশংসিত হয়েছিল। এরা হাসেন দৌলত কাজী ও আলাওল। নিম্নে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলমান কবিদের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো-
দৌলত কাজী : সপ্তদশ শতাব্দীতে আবির্ভূত কবি দৌলত কাজীর 'লোরচন্দ্রানী' বা 'সতীময়না' রোমান্টিক আখ্যানকাব্য হিসেবে প্রসিদ্ধ লাভ করেছে। চট্টগ্রাম রাউজান থানার অন্তর্গত সুলতানপুর গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। আরাকান রাজসভায় তিনি সমাদৃত হন। আরাকানের সমর সচিব আশরাফ খানের পৃষ্ঠপোষকতায় ও উপদেশে ১৬২১ থেকে ১৬০৮ খ্রি. অব্দের মধ্যে কোনো এক সময়ে হিন্দি কাব্য অবলম্বনে লোরচন্দ্রানী বা সতীময়না কাব্যটি রচনা করেন। এর সম্বন্ধে এর বেশি কিছু জানা যায়নি। কিন্তু কাব্যটির প্রায় দুই- তৃতীয়াংশ রচনার পর অকালে তাঁর লোকান্তর হয়। পরে প্রসিদ্ধ কবি সৈয়দ আলাওল আরাকান রাজ্য প্রধানমন্ত্রী সুলেমানের নির্দেশে ১৯৫৯ খ্রি. অব্দে এ কাব্যের বাকি এক-তৃতীয়াংশ সমাপ্ত করেন। দৌলত কাজী মিয়া-সাধনের মৈনাকো সত' কাব্য থেকেই তাঁর সতীময়না' বা 'লোরচন্দ্রানী'র উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন। তার রচনা থেকে কিছু অংশ উদ্বৃত্ত করা হলো-
'নিরঞ্জন-সৃষ্টি নর অমূল্য রতন। ত্রিভুবনে নাহি কেহ তাহার সমান নর বিনে চিন নাহি কিতাব কোৱান। নর সে পরম দেব তন্ত্র মন্ত্র-জ্ঞান | নর সে পরমদেব নর সে ঈশ্বর।
নর বিনে ভেদ নাই ঠাকুর কিঙ্কর
আলাওল : মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলমান কবিদের মধ্যে আলাওল সর্বাধিক জনপ্রিয়। তাঁকে কেউ কেউ মধ্যযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলমান কবি বলে মনে করেন। আলাওল নানা বিষয় অবলম্বনে কাব্য রচনা করে তাঁর প্রতিভার ব্যাপকতার পরিচয় দিয়েছেন। অবশ্য তার কবিত্ব যে খুব উচ্চ স্তরের তা মনে হয় না। সৈয়দ আলাওলের বিচিত্র কাব্য বিষয়ের মতো তাঁর জীবনও বৈচিত্র্যময়। 'সেকেন্দারনামা' ও সয়ফুলমূলকে কবির বিস্তারিত পরিচয় আছে। আরাকানের মুসলমান শাসনকর্তাদের উৎসাহে তিনি আরবি-ফারসি ও হিন্দি কাব্য অবলম্বনে বাংলা কাব্য রচনা করে খ্যাতি লাভ করেন। মুসলমান সমাজে তাঁর অত্যধিক জনপ্রিয়তার কারণে তিনি ইসলামি কাহিনি ও ধর্মতত্ত্বের নানা গ্রন্থ মূল আরবি ও ফারসি থেকে অনুবাদ করেছিলেন। এগুলো হলো : ১. সয়ফুলমূলক- বদিউজ্জামাল, ২. হপ্ত পয়কর, ৩. তোহফা, ৪. সেকান্দার নামা। এগুলোর সমস্তই ইসলামি বিষয় অবলম্বনে মুসলমান সমাজের জন্য লেখা। তাই এই কাব্যগুলো হিন্দু সমাজে আদৌ প্রচার লাভ করেনি। কিন্তু তাঁর প্রসিদ্ধ অনুবাদ কাব্য 'পদ্মাবতী' হিন্দু-মুসলমান উভয় সমাজেই অতিশয় জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। বস্তুত আলাওল বাংলা সাহিত্যে বেঁচে আছেন তাঁর 'পদ্মাবতী' কাব্যের জন্য।
✅ মধ্যযুগের বাংলা লোকসাহিত্যের বিভিন্ন শাখার পরিচয় দাও ।
উত্তর : ভূমিকা : লোকসাহিত্য বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন শাখা। সুপ্রাচীনকাল থেকে মানুষ লোক মুখে মুখে প্রবাদ- প্রবচন, ডাক ও খনার বচন, বিভিন্ন মন্ত্র, তন্ত্র, ছড়া, লোকবিশ্বাস এসব বিষয়গুলো সমাজে প্রচলিত হয়ে আসছে এবং এখনও মানব সমাজে সমাদৃত হচ্ছে। বর্তমান বাঙালি সমাজে লোক সাহিত্যগুলো দিন দিন মর্যাদা পাচ্ছে। এগুলো আমাদের নিজস্ব সম্পদ ও ঐতিহ্য। নিম্নে প্রশ্নালোকে আলোচনা করা হলো-
লোকসাহিত্যের সংজ্ঞা : লোকসাহিত্য বলতে জনসাধারণের মুখে মুখে প্রচলিত গাঁথা, কাহান, গান,
হয়। সাধারণত কোনো জনগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের অলিখিত সাহিত্যই লোকসাহিত্য।
মধ্যযুগের অন্যান্য সাহিত্যের সাথে লোকসাহিত্যের সংযোগ ছিল খুবই প্রত্যক্ষ। সে আমলের কবর- পরম্পরায় সমাজে প্রচলিত হয়ে আসছে। সুপ্রাচীনকাল থেকে এগুলো স্মৃতি নির্ভর ছিল বলে গ্রামীণ অশিক্ষিত।
থেকে উপকরণ সংগ্রহ করে তাদের ধার করা কাহিনির সাথে। আর সেই ধারাগুলো হলো- ছড়া, গান, গীতিকা, কথা, ধাঁধা, প্রবাদ ইত্যাদি ।
ড. আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে, লোকসাহিত্যের মৌখিক ধারার উপর ভিত্তি করিয়াই মঙ্গলকাব্যের লিখিত ধারার সীমাবদ্ধ। লোকসাহিত্যের যে বিষয়ের উপর ভত্তি করিয়া মঙ্গলকাব্যগুলো রচিত হইয়াছে, তাহা প্রধানত ব্রতকথা হইলেও সে উপাদান ও আসিয়া কালক্রমে ইহাতে সংমিশ্রণ লাভ করিয়াছে।
রুশ লোকসাহিত্যবিদ ওয়াই. এম. সকোলড-এর মতে, “ফোকলোর হলো অতীতের প্রতিধ্বনি এবং একই সাথে বর্তমানের এক → লোকসাহিত্যের শ্রেণিবিভাগ : লোক সাহিত্যের শ্রেণিবিভাগ নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে অনেক মতভেদ রয়েছে। যেমন-
শহীদুল্লাহর মতে, লোক সাহিত্যকে প্রধান আটটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা-
(i) গীতিকা বা গাঁথা,
(ii) উপকথা বা রূপকথা,
(iii) ব্রতকথা বা কাহিনি,
(iv) ছড়া,
(v) লোকসংগীত,
(vi) হেয়ালি বা ধাঁধা,
(vii) প্রবাদ,
(viii) ডাক বা খনার বচন
ড. আশুতোষ ভট্টচার্যের মতে-
(i) ছড়া, (ii) গীতিকা, (iii) গীতি,
(vi) কথা, (v) ধাঁধা,
(vi) প্রবাদ-প্রবচন, (vii) পুরাকাহিনি,
(viii) ইতিকথা-মন্ত্র । নিম্নে লোকসাহিত্যের শাখা প্রশাখাগুলো বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
১. ছড়া ছড়া লোকসাহিত্যের প্রাচীনতম সৃষ্টি। এগুলো বিশেষ কোনো ব্যক্তির সৃষ্টি নয়। ছড়ার সুনির্দিষ্ট কোনো রচনাকাল এর রচয়িতাগণও কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি নয়। এগুলো চিরপুরাতন হয়ে শাশ্বত বাঙালির কাছে নিত্য নতুনত্ব লাভ করে। পরিবর্তনশীল এবং এর কোনো নির্দিষ্ট অর্থও থাকে না। সহজ, সরল, লঘুভাব অর্থনীতি বলে এগুলো সহজে শিশুমনকে আকট করে এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেন- আমি ছড়াকে মেঘের সাথে তুলনা করিয়াছি। উভয়েই পরিবর্তনশীল বিবিধ বর্ণে রঞ্জিত বা
যদৃচ্ছাভাসমান ।
ব্যবহারিক জীবন সম্বন্ধীয়, নীতিকথা বিষয়ক, কৃষি বিষয়ক ইত্যাদি
ছড়ার বিষয়বস্তু অনেক বৈচিত্র্যপূর্ণ। যেমন- ছেলেভুলানো ছড়া, খেলাধুলার ছড়া, নানা ধরনের মেয়েলি ছড়া
যেমন : (i) ছেলে ভুলানো ছড়া : “বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান।
শিব ঠাকুরের বিয়ে হলো তিন কন্যা দান ।
এক কন্যে রাধেন বাড়েন এক কন্যে খান। এক কন্যে না খেয়ে বাপের বাড়ি যান ।”
(i) নীতি সম্বন্ধীয় :
(iii) খেলাধুলা বিষয়ক ছড়া:
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-১ (অনার্স দ্বিতীয়
“এ পার গঙ্গা ওপার গঙ্গা মধ্যে খানে চর। তারি মধ্যে বসে আছে শিব সদাগর । শিব গেল শ্বশুরবাড়ি, বসতে দিল পিঁড়ে।
জলপান করিতে দিল শালিধানের চিড়ে ।” “আয় বৃষ্টি ঝোঁপে
ধান দেব মেপে
লেবুর পাতায় করম চা
যা বৃষ্টি ঝরে যা।
খেজুর পাতা হলদে
বৃষ্টি পড়ে জলদে।”
২. গান বা লোকগীতি : ভাটির দেশ বাংলাদেশ। এদেশের নদ নদীতে নৌকা বাইতে গিয়ে মাঝি মাল্লারা অনেক প্রেম বিরহের গান গেয়ে থাকেন। বাংলা সাহিত্যের একবিশাল অংশজুড়ে রয়েছে গান বা লোকগান। লোকগাতিগুলো কোনো একটি বিষয়কে অবলম্বন করে উচিত। বাংলাদেশের লোক সংগীতগুলো সুপ্রাচীন কাল থেকে বাঙালি সমাজে লোক মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে আসছে। এগুলো আমাদের নিজস্ব সম্পদ । বাংলা লোকসংগীতগুলো আমাদের বাংলা লোক গানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। বাংলা লোক সংগীতগুলো বিষয়বস্তুর দিক থেকে বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে । যেমন- জারি সারি, গাজীর গীত, কর্মী সংগীত, সন্ন্যাস ও শোকসঙ্গীত, গম্ভীরা, ধুয়া গান, মেয়েলি গীত টয়া গীত, কবিগান, ব্রত সংগীত, মুর্শিদী গান, মারফতী, কর্মসংগীত, বিরহসংগীত, ছাদ পিটানোর গান, মৌষালীগীত ইত্যাদি।
তবে অঞ্চলভেদে লোক গীতির পার্থক্য আছে। গানের প্রকৃতি, জাতি ও সম্প্রদায়গত বৈচিত্র্যের জন্য কোনো কোনো অঞ্চলে বিশেষ ধরনের লোকগীতির প্রসার ঘটে। যেমন- পশ্চিমবঙ্গে পটুয়া, ভাদু, ঝুমুর, উত্তরবঙ্গে গম্ভীর, জাগ, ভাওয়াইয়া, পূর্ববঙ্গের জারি, ঘাটু উল্লেখযোগ্য । যেমন-
(i) “হিন্দু কি যবনের বালা
মানা নাই কো কারো বেলা প্রেম পণ্য রূপের গোলা
আঁজলা ভরে নিয়ে যা রে ॥” (মহিনশাহ)
(ii) “আমার ঘরের চাবি পরের হাতে।
কেমনে খুলিয়ে সে ধন দেখব চক্ষেতে ॥
আপন ঘরে বোঝাই সোনা।
পরে করে লেনা দেনা
৩. গীতিকা : গীতিকা বলতে একশ্রেণির আখ্যানমূলক গানকে বুঝায়। ইংরেজি Ballad শব্দের বাংলা অর্থ গীত বা না। কাহিনি হয় দৃঢ় সংবদ্ধ। একটিমাত্র পরিণতির লক্ষ্যে গীতি সংলাপ ও ঘটনাপ্রবাহ কাহিনিকে দ্রুত এগিয়ে নেয়। নীতিকাগুলো কাহিনি প্রধান, গীতিশীল এবং নাটকীয় গুণসম্পন্ন। বাংলা সাহিত্যে গীতিকাগুলো মূলত গান হিসেবে গাওয়ার উদ্দেশ্যে রচিত। এ সুরের চেয়ে কাহিনিই প্রাধান্য থাকে। ছোটগল্পের মতো একটি মাত্র কাহিনির ধারা অনুসরণ করে গীতিকাগুলো আসা হয়। প্রভাবশালী কবি কর্তৃক কোনো ঘটনাকে অবলম্বন করে গীতিকাগুলো রচিত এবং লোক পরম্পরায় এগুলো গীতি হয়ে মূল কাহিনির আছে। সংযুক্ত হতো।
যেমন- “নাহি আমার মাতা পিতা গর্তসুদর ভাই
সুতের হেওলা অইয়া ভাইস্যা বেড়াই |
কঠিন তোমার মাতাপিতা কঠিন তোমার থাণ
এমন যইবন তোমার যায় অকারণ ।"
✅ মধ্যযুগের অনুবাদ সাহিত্য শাখার পরিচয় সংক্ষেপে আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : যখন কোনো একটি ভাষার সাহিত্যকর্ম অন্য ভাষায় অনূদিত হয় তখন তাকে অনুবাদ সাহিত্য ক কোনো মৌলিক রচনা নয়; অনুবাদ কর্মের দ্বারা এক ভাষায় শিল্প সম্পদ অন্য ভাষায় সঞ্চারিত হয়। সাধারণত ভাষান্তরিত হয়ে থাকে। অনুবাদ সাহিত্য মৌলিক রচনা না হলেও অনুবাদ সাহিত্য কতটা কার্যকর তা সহজেই বুঝতে পারি।
মধ্যযুগের অনুবাদ সাহিত্য : মধ্যযুগের (১২০১-১৮০০) বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ধারার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অনুরু অনুবাদ সাহিত্য মৌলিক সাহিত্য নয়। মৌলিক সাহিত্য না হলেও বাংলা সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধিতে অনুবাদ সাহিত্যে। প্রভাব ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এসম্পর্কে ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তার বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত গ্রন্থে বা “রামায়ণ মহাভারত-ভাগবতের অনুবাদ না থাকলে বাংলা কাব্য গ্রাম্য সাহিত্য হয়েই থাকত। উচ্চতর মর্যাদা
পারতো না।”
মধ্যযুগের অনুবাদ সাহিত্যের প্রকারভেদ : মধ্যযুগের অনুবাদ সাহিত্যকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা হয় যথা- ১. আক্ষরিক অনুবাদ (Literal translation) ও
২. ভাবানুবাদ (Faithful translation)
বাংলা সাহিত্যে অনুবাদ সাহিত্যের শুভাগমন ঘটে খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে। বাংলা সাহিত্যে অনুবাদ সাহিত্যের বলতে গেলে বলা যায়, দীর্ঘ দু'শত বৎসরব্যাপী (১২শ-১৪শ) পাঠান শাসনে বাংলার হিন্দুসমাজে যে ভাঙন ধরেছিল তা তুলতে হলে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির মূল কেন্দ্র রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবতের আদর্শ, নীতি, তত্ত্ব ও কাহিনির পুনঃপ্রচারের আব যুগের সমাজনেতারা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিলেন। তারা আরও বুঝতে পেরেছিলেন শুধু জীমূত বাহনের স্মৃতিশাস্ত্রের মা বাঁধনে হিন্দু সমাজকে দুর্গতির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে না। হিন্দু সমাজের সর্বশ্রেণির মধ্যে নিজ নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতির ফিরিয়ে আনতে হলে পৌরাণিক সাহিত্য বিশেষত রামায়ণ মহাভারতের প্রচার অত্যাবশ্যক। তাই তারা অনুবাদের মারফতে সাহিত্যের মূল নির্যাস প্রচারে ব্রতী হয়েছিলেন। আর এভাবেই বাংলা সাহিত্যে অনুবাদ সাহিত্যের আগমন ঘটে
মধ্যযুগের অনুবাদ সাহিত্যের সমৃদ্ধিতে মুসলমানদের ভূমিকা : মধ্যযুগের সিংহভাগ সময় (১৩৫০-১৭৫৭ খ্রি.)। মুসলমানরা শাসন করে। আর এই সময়কালকে মুসলিম যুগ বলা হয়। মধ্যযুগের অনুবাদ সাহিত্যের সমৃদ্ধিতে মুসলমান অবদান সর্বজনবিদিত।
ইকোনো সাহিত্য প্রচার এবং বিকাশ সসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ব্যতিরেকে অসম্ভব। আর এই ক্ষেত্রে মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভে ধন্য হয়েছিলেন অনুবাদ সাহিত্য। মুসলিম-পূর্ব সেন যুগে বর্ণবাদী সমাজব্যবস্থার প্রচলন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মুসলিম যুগে বর্ণবাদী প্রবণতা না থাকায় সাহিত্য চর্চার দুয়ার সকলের জন্য অবারিত ছিল। এ প্রসঙ্গে প্রমথ চৌধুরী বলেন, “মুসলিম যুগে সম্ভবত বঙ্গদেশে হিন্দু সম্প্রদায় তার স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ বজায় রেখেছে।”
মুসলমান শাসকরা হিন্দু কবি ও পণ্ডিতদের কাছ থেকে রামায়ণ-মহাভারতের গল্প শুনতে চাইতেন এবং এই মহাকাব্যগুলো বাংলা ভাষায় রচনা করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। হোসেন শাহ ভাগবত রচনার জন্য মালাধর বসুকে নিযুক্ত করেছিলেন। পরাগল খান এবং ছুটি জান দু'জনই তাদের হিন্দু সভাকবিদের দ্বারা মহাভারত রচনা করে নিয়েছিলেন। আর এভাবেই মুসলমান শাসকরা ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত রেখে অনুবাদ সাহিত্যের সমৃদ্ধির পথ খুলে দিয়েছিলেন। অনুবাদকের মর্মস্পর্শী, সরল ও ভাবঘন লেখনীর কারণেই বাংলায় অনুবাদ সাহিত্য সার্থক রূপ লাভ করে। অনুবাদকরা মূল গ্রন্থকে সংক্ষেপে নিজের ভাষায় পায়ারোষিপটীতে রচনা করে স্বল্পশিক্ষিতের মানসিক ভোজের অনুকূল খাদ্য পরিবেশন করেছেন। পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দীর অনুবাদকদের মধ্যে জনপ্রিয় কয়েকজনের নাম এখানে উল্লেখ করা হলো-
১. কৃত্তিবাস ওঝা, ২. কবীন্দ্র পরমেশ্বর, ৩. শ্রীকরনন্দী, ৪. মালাধর বসু, ৫. অদ্ভূত আচার্য, ৬. চন্দ্রাবতী, ৭. কাশীরাম দাস, ৮. নিত্যানন্দ ঘোষ, ৯. দ্বিজ গঙ্গানারায়ণ, ১০. ঘনশ্যামাদাস, ১১. কৃষ্ণদাস কবিরাজ, ১২. পরশুরাম ও ১৩. দ্বিজ হরিদাস প্রমূখ ।
বিভিন্ন ভাষার শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম থেকে অনুবাদের মাধ্যমে নতুন ভাষা কেবল প্রকাশরীতি ও শব্দ ভান্ডারের দিক থেকেই সমৃদ্ধ হয় না। শ্রেষ্ঠত্বের ভাব কল্পনার সাথেও পরিচিত হতে পারে। বিভিন্ন ভাষা থেকে মধ্যযুগে যেসব কাব্য অনূদিত হয়েছে তার সংখ্যাও কম ময়। মধ্যযুগের অনুবাদ ধারাকে ভাষাগত দিক থেকে ৪ ভাগে ভাগ করতে পারি । যথা-
১. সংস্কৃত ভাষা থেকে, ২. আরবি ভাষা থেকে, ৩. ফারসি ভাষা থেকে, ৪. হিন্দি ভাষা থেকে।
✅ মঙ্গলকাব্য কী? চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের বিভিন্ন কবিদের পরিচয় পাও ।
উত্তর: মঙ্গলকাব্য : মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম নিদর্শন মঙ্গলকাব্য। আনুমানিক খ্রিস্টীয় প্রায়োদশ শতাব্দী হতে শুরু করে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এ কাব্য রচিত হয়েছে। বিভিন্ন দেবদেবীর প্রচার সম্বন্ধীয় এক প্রকার আখ্যানকাব্যকে মঙ্গলকাব্য আর্যরা বাঙালি সম্প্রদায় নিজ নিজ সমস্যা সমাধান উপলক্ষে চণ্ডী, মনসা, বাতলী, ধর্ম প্রভৃতি লৌকিক দেবদেবীর স্তুতিমূলক এ কাব্য পাঠ্য করতো। দেবতাদের কাছে মঙ্গল কামনা করে যে কাব্যগুলো রচিত তাই মঙ্গলকাব্য ।
প্রত্যেক মঙ্গলকাব্যের নায়কই একজন স্বর্গ ভ্রষ্ট দেবর্ণিত। অভিশাপগ্রান্ত হয়ে কোনো দেবতার পূজা প্রচারের জন্য মানবীয় পর্বে পৃথিবীতে তাকে জন্ম নিতে হয় । পূজা প্রচারের বিপদসঙ্কুল পরে মঙ্গলকারী দেবতা তাকে রক্ষা করে। অবশেষে মর্ত্যে দেবীর পূজা প্রতিষ্ঠার পর শাপমুক্ত হয়ে স্বর্গে প্রত্যাবর্তন করে। মঙ্গলকাব্যের কিছু অংশে দেবকাহিনি, বাকি অংশ মর্তকাহিনি বর্ণিত হয়। সাধারণত মঙ্গলকাব্যগুলোতে চারটি অংশ থাকে যেমন-
১. বন্দনা,
২. গ্রন্থ রচনার কারণ বর্ণনা,
৩. দেবখণ্ড ও
৪. নরখণ্ড বা মূলকাহিনি বর্ণনা ।
D মঙ্গলকাব্যের বৈশিষ্ট্য : মঙ্গল কাব্যের বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে তুলে ধরা হলো-
১. মঙ্গলকাব্য ধর্মনির্ভর আখ্যানকাব্য;
২. দৈবশক্তির বিরুদ্ধে মানবজীবনের দ্বন্দ্ব সংঘাত এ কাব্যের উপজীব্য:
৩. মঙ্গলকাব্যের কবি সাধারণত স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে কাব্য রচনায় আত্মনিয়োগ করে;
৪. মঙ্গলকাব্যের দেবতার মর্তলোকে প্রজা প্রচারের মূল লক্ষ্য;
৫. এ কাব্যের ছন্দ প্রধানত পয়ার ও ত্রিপদী ও
৬. ধর্মীয় কাহিনির অন্তরালে সমকালীন সমাজ ও রাষ্ট্র চিত্ত অঙ্কিত হয়।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মঙ্গলকাব্যের ধারায় চণ্ডীমঙ্গল বিশিষ্ট স্থান জুড়ে আছে। চন্ডীদেবীর কাহিনি অবলম্বনে রচিত চন্ডীমঙ্গল বা। এ দেশে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। অনেক কবি এ কাহিনি অবলম্বনে কাব্য রচনা করেছিলেন। নিম্নে চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের প্রধান প্রধান কবিদের পরিচয় দেওয়া হলো-
মানিক দত্ত : মানিক দত্তকে চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের প্রাচীনতম কবি বলে ধারণা করা হয়। চণ্ডীমঙ্গলের শ্রেষ্ঠ কবি মুকুন্দরামের কবিবন্দনা মালিক দত্তের নাম উল্লেখ করা হয়েছে যেমন-
“মানিক দত্তেরে আমি করিয়ে বিনয়।
যাহা হৈতে হৈল গীত পথ পরিচয়।”
এতে মনে করা হয় মানিক দত্তই চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের ধারা প্রবর্তন করেছিলেন। তবে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে প্রাপ্ত মানিক পান্ডের পুঁথি, যা পার করো শতকের কবি মনে করেন। আবার সুকুমার সেনের মতে, তাঁর আবির্ভাব অষ্টাদশ শতকে। তবে তার সীমাবদ্ধতা অর্বাচীন। ফলে মানিক দত্তের আবির্ভাব কাল সম্পর্কে গবেষকদের মধ্যে যথেষ্ট মতানৈক্য আছে। ড. দীনেশচন্দ্র সেন মানিক তার সঠিক পরিচয় পাওয়া যায়নি। কিন্তু কবির আত্মপরিচয় থেকে জানা যায় যে, নিবাস ছিল মালদহ জেলা তিনি কানা ও খোঁড়া। দেবীর করে তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেন এবং দেবীর স্বপ্নাদেশে কাব্য রচনা করেন।